অ্যাসপিরিন (Aspirin) হচ্ছে একটি বহুল ব্যবহৃত ওষুধ, যার প্রধান উপাদান Acetylsalicylic Acid। এটি মূলত ব্যথানাশক, জ্বর কমানোর ও প্রদাহনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া এটি রক্ত পাতলা করার ঔষধ হিসেবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে হৃদরোগ এবং স্ট্রোক প্রতিরোধে।
Table of Contents
Aspirin এর ফার্মাকোলজি (যেভাবে কাজ করে)
- বিষয়: Acetylsalicylic acid
- প্রক্রিয়া: অ্যাসপিরিন শরীরে প্রবেশ করে COX-1 ও COX-2 এনজাইমকে ব্লক করে, ফলে Prostaglandins এবং Thromboxane A2 উৎপাদন বন্ধ হয়। এর ফলে ব্যথা ও প্রদাহ কমে এবং রক্ত জমাট বাঁধা রোধ হয়।
- বায়োঅ্যাভেইলেবিলিটি: প্রায় ৮০–১০০%।
- হাফ লাইফ (Half-life): ১৫–২০ মিনিট, তবে অ্যাকটিভ মেটাবোলাইট (Salicylate) ৩–৬ ঘন্টা কাজ করে।
- এক্সক্রিশন: মূত্রের মাধ্যমে।
অ্যাসপিরিন ঔষধ এর ব্যবহার
হালকা থেকে মাঝারি ব্যথা উপশমে
- মাথাব্যথা।
- দাঁতের ব্যথা।
- পেশি বা জয়েন্টের ব্যথা।
- মাসিকের সময় ব্যথা।
জ্বর কমানোর জন্য
- ভাইরাসজনিত বা অন্যান্য কারণে সৃষ্ট শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে।
প্রদাহ কমানোর জন্য
- আর্থ্রাইটিস বা বাতজ্বরের মতো প্রদাহজনিত রোগে।
রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধে (Antiplatelet)
- হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য দৈনিক লো-ডোজ অ্যাসপিরিন।
- হার্ট অ্যাটাক ও ইসকেমিক স্ট্রোক প্রতিরোধে।
অ্যাসপিরিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
যদিও Aspirin বহু রোগের জন্য উপকারী ও কার্যকরী একটি ওষুধ, তবে এটি ব্যবহারের ফলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এসব প্রতিক্রিয়া রোগীর শারীরিক অবস্থা, মাত্রা, এবং দীর্ঘমেয়াদি সেবনের উপর নির্ভর করে ভিন্ন হতে পারে।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা
- পেটব্যথা, বুকজ্বালা, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা
- গ্যাস্ট্রিক বা ডিউডেনাল আলসার (পাকস্থলীর ঘা)
- রক্তাক্ত বমি বা মেলেনা (কালো রঙের পায়খানা)
- অ্যাসপিরিন পাকস্থলীর দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে GI bleeding (পাকস্থলীতে রক্তপাত) ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যদি এটি খালি পেটে খাওয়া হয় বা দীর্ঘদিন নিয়মিত খাওয়া হয়।
রক্তপাতের ঝুঁকি
- অ্যাসপিরিন রক্তে প্লেটলেট জমাট বাঁধার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, ফলে শরীরের যেকোনো অংশে হঠাৎ রক্তপাত হতে পারে।
- মাড়ি থেকে রক্ত যাওয়া, নাক থেকে রক্ত পড়া, বা ত্বকের নিচে সহজে আঘাতে নীল দাগ পড়া দেখা যেতে পারে।
- মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (Intracranial hemorrhage) – খুবই জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া ও শ্বাসকষ্ট
- ত্বকে ফুসকুড়ি, চুলকানি, ফোলাভাব (বিশেষ করে মুখ, ঠোঁট, জিভ)।
- অ্যাজমার প্রকোপ বাড়ানো, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা হাঁচি-কাশির সমস্যা।
- যারা NSAID বা অ্যাসপিরিন সেনসিটিভ, তাদের ক্ষেত্রে Anaphylaxis (হঠাৎ তীব্র অ্যালার্জিক রেসপন্স) হতে পারে, যা জীবনহানিকর হতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে Reye’s Syndrome
- ১৬ বছরের নিচে শিশুদের ভাইরাসজনিত জ্বর বা ফ্লু অবস্থায় Aspirin tablet খাওয়ালে Reye’s Syndrome নামক একটি বিরল কিন্তু মারাত্মক নিউরোলজিক্যাল ও লিভার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- এই কারণে শিশুদের জন্য অ্যাসপিরিন সাধারণত নিষিদ্ধ, যদি না চিকিৎসক স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেন।
স্নায়ুবিক ও কানে সমস্যা
- টিনিটাস (কানে সাঁ সাঁ শব্দ শোনা)
- উচ্চ মাত্রার সেবনে হালকা মাথা ঘোরা, বিভ্রান্তি, এমনকি খিঁচুনি হতে পারে
কিডনি ও লিভারের উপর প্রভাব
- দীর্ঘমেয়াদি বা উচ্চমাত্রায় সেবনে কিডনি ও লিভার ফাংশন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
- যাদের আগে থেকেই এই অঙ্গগুলোতে সমস্যা আছে, তাদের জন্য ঝুঁকি আরও বেশি
বিশেষ সতর্কতা
যদি আপনি নিচের লক্ষণগুলোর যেকোনোটি অনুভব করেন, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন:
- পেট বা বুকের মধ্যভাগে তীব্র ব্যথা।
- রক্তমিশ্রিত বমি বা কালো পায়খানা।
- হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বা শ্বাস নিতে অসুবিধা।
- মুখ বা গলার ফোলাভাব।
- জ্বরের সঙ্গে অচেতনতা বা খিঁচুনি (বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে)।
কারা অ্যাসপিরিন খাবেন না?
- গ্যাস্ট্রিক আলসার বা হেমোরেজের ইতিহাস।
- রক্ত পাতলা করার ওষুধ নিচ্ছেন এমন রোগী।
- অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণকারী ব্যক্তি।
- অ্যাজমা বা অ্যালার্জি প্রণব।
- গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মা।
- যকৃত বা বৃক্কের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি।
- শিশু ও কিশোর বয়সীরা (Reye’s Syndrome ঝুঁকির জন্য)।
অ্যাসপিরিন এর মাত্রা ও সেবনবিধি
Aspirin tablet এর মাত্রা নির্ভর করে রোগের ধরন, লক্ষণ, বয়স এবং ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী। এটি সাধারণত মুখে খাওয়ার বড়ি (oral tablet) আকারে গ্রহণ করা হয়। নিচে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত অ্যাসপিরিনের সাধারণ মাত্রা দেওয়া হলো:
ব্যথা ও জ্বরের জন্য
- মাত্রা: প্রতি ৪–৬ ঘণ্টা অন্তর ৩০০–৬০০ মিলিগ্রাম।
- সর্বোচ্চ দৈনিক মাত্রা: ৪,০০০ মিলিগ্রামের বেশি না।
- উপযোগী: মাথাব্যথা, দাঁতের ব্যথা, পেশি ব্যথা, সর্দি-জ্বর ইত্যাদি।
প্রদাহ বা আর্থ্রাইটিসের জন্য
- মাত্রা: দিনে ৩–৪ বার ৫০০–১০০০ মিলিগ্রাম।
- ব্যবহার: দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, গাঁটের ব্যথা, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস।
- দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারের আগে গ্যাস্ট্রিক প্রতিরোধক ওষুধ সেবন করা পরামর্শযোগ্য।
হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে
- মাত্রা: দৈনিক ৭৫–১৫০ মিলিগ্রাম।
- ব্যবহার: হৃদরোগ প্রতিরোধ, পূর্বে হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকলে আবার যাতে না হয় তা প্রতিরোধে।
- Low-dose aspirin বলা হয়ে থাকে এই মাত্রাকে (baby aspirin নামেও পরিচিত)।
স্ট্রোক প্রতিরোধে
- মাত্রা: দৈনিক ৮১–৩২৫ মিলিগ্রাম (ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে)।
- ব্যবহার: যাদের রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি বেশি, স্ট্রোকের ইতিহাস আছে বা TIA (Transient Ischemic Attack) হয়েছে।
শিশুদের ক্ষেত্রে
- সেবন: শুধুমাত্র চিকিৎসকের সুস্পষ্ট পরামর্শে।
- কারণ: ভাইরাসজনিত রোগে অ্যাসপিরিন খাওয়ালে শিশুদের Reye’s Syndrome নামক একটি মারাত্মক ও বিরল সমস্যা হতে পারে, যা মস্তিষ্ক ও যকৃতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- তাই ১৬ বছরের নিচে শিশুদের অ্যাসপিরিন সেবন সাধারণত নিষিদ্ধ।
গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা:
- Aspirin খালি পেটে খাওয়া উচিত নয়। এটি পেটে অম্লতা বাড়িয়ে গ্যাস্ট্রিক বা আলসার তৈরি করতে পারে। তাই খাবারের পরে খাওয়া নিরাপদ।
- প্রচুর পানি সহকারে সেবন করা ভালো, যাতে ওষুধ পাকস্থলীতে আটকে না থাকে।
- অতিরিক্ত মাত্রা (Overdose) হতে পারে বিষক্রিয়া, যার ফলে হতে পারে বমি, কানে শব্দ শোনা (Tinnitus), মাথা ঘোরা, এমনকি কোমা।
বাংলাদেশে অ্যাসপিরিনের জনপ্রিয় ব্র্যান্ড ও কোম্পানি
বাংলাদেশে Aspirin ওষুধটি বিভিন্ন কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন ব্র্যান্ড নামে বাজারজাত করে থাকে। নিচে বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া যায় এমন কিছু জনপ্রিয় অ্যাসপিরিন ব্র্যান্ড এবং সংশ্লিষ্ট ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেওয়া হলো:
- Ecosprin – প্রস্তুতকারী: Sandoz (ইম্পোর্টেড ব্র্যান্ড)
- Aspilets – প্রস্তুতকারী: Square Pharmaceuticals Ltd.
- Cardin – প্রস্তুতকারী: Renata Limited
- Ascard – প্রস্তুতকারী: Beximco Pharmaceuticals Ltd.
- Astrix – প্রস্তুতকারী: Aristo Pharma Ltd.
- Flodin – প্রস্তুতকারী: Incepta Pharmaceuticals Ltd.
- Thrombotin – প্রস্তুতকারী: Aristopharma Ltd.
- Aspirin 300 – প্রস্তুতকারী: GSK (GlaxoSmithKline) – ইম্পোর্টেড ব্র্যান্ড
অতিরিক্ত তথ্য:
- প্রতিটি ব্র্যান্ডে ডোজ (যেমন: 75mg, 150mg, 300mg) ভিন্ন হতে পারে, তাই সঠিক মাত্রায় সেবনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
- হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধে সাধারণত লো-ডোজ অ্যাসপিরিন ব্যবহার করা হয় (৭৫–৮১ মি.গ্রা)।
- যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে, তারা এন্টারিক কোটেড (Enteric-coated) ট্যাবলেট গ্রহণ করলে উপকার পেতে পারেন।
অ্যাসপিরিন কিসের ঔষধ এটি একাধারে ব্যথানাশক, জ্বর কমানো, প্রদাহ কমানো ও হৃদরোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ ঔষধ। তবে সঠিক মাত্রা ও সতর্কতার সঙ্গে সেবন না করলে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে মারাত্মক।
Aspirin শুরু বা বন্ধ করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
আপনি যদি অ্যাসপিরিন কিসের ঔষধ এবং এই জাতীয় ট্যাবলেট এর কাজ কি এবং খাওয়ার নিয়ম সহ ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং উপকারীতা সম্পর্কে জানেন। তাইলে চাইলে এরকম সকল ঔষধের নাম ও কার্যকারিতা জানতে হলে আমাদের ওয়েবসাইটের অন্যান্য প্রতিবেদনগুলো দেখুন।